ঢাকা ০৫:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo পাংশার মাছপাড়ায় মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান Logo পাংশা মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিনের সাথে রিপোর্টার্স ইউনিটির সৌজন্য সাক্ষাৎ Logo কালুখালীতে বিএনপি’র উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস পালিত Logo রাজবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস পালিত Logo জনতা ব্যাংক পিএলসি’র উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস পালিত Logo রাজবাড়ীতে শুদ্ধ বাংলা সংগীত রক্ষা পরিষদের শ্রদ্ধা নিবেদন Logo বাংলাদেশ ভূমি অফিসার কল্যাণ সমিতি রাজবাড়ী জেলা শাখার উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস পালিত Logo মহান বিজয় দিবসে রাজবাড়ী রিপোর্টার্স ইউনিটির শ্রদ্ধা নিবেদন Logo যথাযোগ্য মর্যাদায় ডা: আবুল হোসেন কলেজে মহান বিজয় দিবস পালিত Logo ডা: আবুল হোসেন কলেজে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত
আজ অর্ণের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী

অর্ণ একটি নক্ষত্রের নাম

এক জীবনে কতটা পথ অতিক্রম করলে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায়? অর্ণ নামে যে গোলাপটি বৃন্তচ্যুত হলো অথবা যে নক্ষত্রটির পতন হলো আজ তাকে কে মনে রাখবে! বৃক্ষ নাকী আকাশ?
জন্মের পরে জীবন শুরু হয় শিশুর ; পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে মানুষ হবার বয়সে। প্রিয় অর্ণ সবে মানুষ হবার বয়স হয়েছিলো মাত্র অথচ পরিপূর্ণ মানুষ হবার পূর্বেই তাকে পৃথিবীর স্থান ছেড়ে দিতে হলো, ছেড়ে যেতে হলো বাবা-মা,ভাই-বোন, সহপাঠী বন্ধু স্বজন। আমরা জন্ম-মৃত্যুর বিধান জানি,জানি না মৃত্যর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে ধর্ম,দর্শন ও বিজ্ঞানে ভিন্ন মতবাদ বা মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আমরা স্রষ্টা প্রদত্ত সংবিধানে অনুগত হই পূর্ণ বিশ্বাসে। বিশ্বাস হলো দৃশ্যমান বস্তুর সাথে লিখিত বা পঠিত বিষয়ের সাদৃশ্য বা মিল। পক্ষান্তরে এক অদৃশ্য শক্তির প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রকাশের নামই হলো বিশ্বাস । শেষ কথা বিশ্বাসই হলো স্রষ্টা,আল্লাহ,ঈশ্বর,ভগবান আমরা যে নামেই ডাকি না কেন তিনিই একমাত্র শক্তি যিনি পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস তিনিই পরমসত্তা।
সৃষ্টির পর থেকে আজ অব্দি মানুষ জন্ম নিয়েছে, জন্ম নিচ্ছে,জন্ম নিবে এবং মৃত্যু হয়েছে,মৃত্যু হচ্ছে,মৃত্যু হবে এবং একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে গোটা পৃথিবী। এটাই জন্ম-মৃত্যুর সরল প্রক্রিয়া এই জন্ম নেয়াটা মানুষের ইচ্ছাধীন নয়, জন্ম দেয়াটা মানুষের ইচ্ছাধীন।সৃষ্টিতে স্রষ্টা একক শক্তি তিনিই পরমসত্তা, তার কোন সহযোগী নেই অথচ জন্মে দ্বৈত ভূমিকা থাকে পিতা-মাতার। এই মানুষের ভেতরেই আবার স্রষ্টা অবস্থান করেন। এই যে জন্মের সাথে মৃত্যুর বন্ধন এটাও বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। আল্লাহর উপর  বিশ্বাস আছে বলেই আমরা জন্ম-মৃত্যুকে মনে নিই, মেনে নিই। এই মনে নেয়া আর মেনে নেয়াটা জন্মের ক্ষেত্রে আনন্দের হলেও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অধিক কষ্টের।
বাবা-মায়ের আগে সন্তানের মৃত্যু হলে সেই আঘাত মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়ে অধিক কষ্টের। তবুও আমরা বিশ্বাস করি মানুষের অন্তরেই স্রষ্টার আবাস।
অর্ণের মতো হাজারো শিশু কিশোর জন্ম-মৃত্যুর এই অসম আসা যাওয়া যেন ষ্টেশনে পরে আসা ট্রেনের মতো ! অর্ণ বাপ আমার, তুমি তো পরে এসেছিলে পৃথিবীতে,অনেক পরে তবে কেন তুমি আগেই চলে গেলে না ফেরার দেশে? যে দেশ থেকে আর কখনো কেউ ফিরে আসে না।
আমরা জানি পৃথিবীতে মানুষের আগমন এবং উর্ধলোকে প্রস্থান কোনটাই রেল লাইন ধরে চলে না। আমাদের অবুঝ মন মৃত্যু নামক সত্যটাকে মেনে নিতে পারে না বলেই অতি আবেগে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে কী অপরাধ ছিলো অর্ণের,যে তাকে এই অসময়ে সময় হলো চলে যাবার?  এমন প্রশ্ন হাজার মানুষের। তবে এটা মানুষের সহজাত কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। আমরা জানি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সমান ওজন হয়ে যায়। এ ভার বহন করার ক্ষমতা কোন বাবাই রাখেন না। তবুও বহন করেন এবং সে সক্ষমতার যোগান তিনিই দিয়ে থাকেন।
দূরন্ত শৈশবে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতো যে ছেলেটি, দেখে মনে হতো বাবা যেন একটা কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ,ছেলে ফুল হয়ে ফুটে আছে শাখা প্রশাখায়।  মায়ের পাশে বসে যখন স্কুলে যেতো, মনে হতো মা যেন মাথার উপর নীলাকাশ আর ছেলেটি সেই আকাশ ছুঁয়ে থাকা প্রদীপ্ত রবি। আজ সকাল থেকে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষটি শোকে মুহ্যমান,কলি থেকে ফুল ফুটছে না আর, ফুটবে না আর কখনোই। কেন আজ হঠাৎ দুপুরের আগেই অস্তমিত হলো সকালের সূর্যটা। এ আমার অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নয়,এ আমার আক্ষেপ নয়, এ আমার অজ্ঞতা প্রসূত দুঃখবোধ। মানুষের একটাই জীবন অথচ ইচ্ছে বহুতর। মানুষ হবার দূর্বার ইচ্ছা নিয়ে ছেলেটির এগিয়ে যাওয়া আমাদের মননে ঋদ্ধতার চিত্রকল্প এঁকে দিয়েছিলো।পড়া লেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সে বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলো। স্টেডিয়াম কিংবা জিলা স্কুলের সবুজ ঘাসের অন্তর জুড়ে ছিলো তার সরব পদচারনা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলো অর্ণ। নৈতিক ও মানবিক গুণাবলিতেও সে অন্যসব বন্ধুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো।
শ্রেষ্ঠ মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষক, পাশাপাশি বাবা -মা-ই সন্তানের প্রথম শিক্ষক এবং একই দায়িত্ব নিয়ে সন্তানকে আদর্শ ও মানবিক মানুষ করে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। বাবা-মা তাদের কারিগর হাতে কাঁদামাটির তৈরি সন্তানকে সোনার মানুষে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। মনের আলমিরায় হাজারো ইচ্ছের ফুল সাজিয়ে সুগন্ধি ছড়াতে চেয়েছিলেন। আজ অর্ণ নেই, মাটির মানুষ মাটিতেই মিলেয়ে গেছে। সক্রেটিস হেমলক পান করার পর বলেছিলেন তোমরা দুঃখ করো না মনে রেখো মৃত্যু কেবল আমার দেহটাকেই  বিনাশ করবে আত্মাকে নয়। অর্ণ আজ তুমি নেই অথচ তোমার অবিনাশী আত্মা আমাদের অন্তরে ভালোবাসায় চির জাগরুক থাকবে চিরদিন। মনে এখন বেদনার বহ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে তবুও তুমি আমাদের অন্তরাত্মা হয়ে চির অম্লান রবে। অর্ণ ছিলো বাবা-মায়ের অন্তরে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ অথচ আজ তা অন্তরেই শুকিয়ে গেছে।
বন্ধু হারানোর বেদনায় নির্বাক বন্ধুরা,শোকে বিহ্বল প্রাণহীন দেহের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে। মাঝে মাঝে  কবরস্থানে বন্ধু অর্ণের জন্য নিরবে প্রার্থনা করে। খেলার মাঠে অর্ণের পদচিহ্ন খুঁজে ফেরে রোজ। পুকুর ঘাটে সেই বসার জায়গাটি সযত্নে আগলে রেখেছে এখনো। ভুলে থাকার চেষ্টায় ভুলে যেতে চায় অর্ণের সব স্মৃতি কিন্তু পারে না,পারা যায় না। যে জল প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে মানুষের সেই জলই সংগোপনে প্রাণ কেড়ে নেয় মানুষের। অর্ণ অসম্ভব সম্ভাবনাময় একটা জীবনের নাম অথচ খেলার ছলেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো সেই জীবনের। আহা কী নির্মম কী নিষ্ঠুর এই মৃত্যু। অর্ণ বাঁচতে চেয়েছিলো কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করে সাধ্য কার?
আজ বাকরুদ্ধ পরিবার পরিজন, বন্ধু, সুহৃদ স্বজন । বাবা- মা তাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু না তিনি যাকে নিতে  চান তাকে আর ফেরত দেন না কখনোই।এই পরম ও চরম সত্যটাকে মেনে নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস যোগাতে হবে মনে। যিনি সৃষ্টি করেছেন জীব জগৎ কিংবা বিশ্বব্রম্মাণ্ড মৃত্যু এবং ধবংস করার ক্ষমতা তিনিই সংরক্ষন করেন।
পরিসংখ্যান বলে প্রতিবছর বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে তন্মধ্যে সাঁতার না জানার কারণেই অধিকাংশ শিশু কিশোরের মৃত্যু হয়। শিশুরা মারা যায় অভিভাবকদের অসতর্কতার কারণে।
ছেলে মেয়েদের জন্য সাঁতার শেখা কতটা জরুরী তা উপলদ্ধি করেই অর্ণ মারা যাবার পরের দিন রাজবাড়ীতে অর্ণের স্মৃতি রক্ষার্থে “অর্ণ সুইমিং ক্লাব” নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য রাজবাড়ী জেলার বিশেষ করে শহরে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানো। এই মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কিছু ব্যক্তি এগিয়ে এলেও প্রয়োজন সরকারি/বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতা।  এই সংগঠনের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে প্রতিটি ছেলে মেয়েকে সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম শুরু হলে অবশ্যই সফলতা আসবে এবং মা-বাবার বুক শূন্য করে হাজারো শিশু, কিশোর-কিশোরীকে আর পানিতে ডুবে  অকালে প্রাণ হারাতে হবে না। আমরা আর হারাতে চাই না মেধা,তন্ময়,রহমান ও অর্ণের মতো আরো অনেক নাম না জানা মেধাবী এবং সম্ভাবনাময় জীবন। অর্ণ তুমি আমাদের অন্তরাকাশে উজ্জল নক্ষত্র হয়েই থাকবে চিরদিন। জান্নাতের সব দরজা খোলা রবে তোমার জন্য।
জনপ্রিয় সংবাদ

পাংশার মাছপাড়ায় মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান

আজ অর্ণের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী

অর্ণ একটি নক্ষত্রের নাম

আপডেট সময় ০৭:১০:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০২৪
এক জীবনে কতটা পথ অতিক্রম করলে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায়? অর্ণ নামে যে গোলাপটি বৃন্তচ্যুত হলো অথবা যে নক্ষত্রটির পতন হলো আজ তাকে কে মনে রাখবে! বৃক্ষ নাকী আকাশ?
জন্মের পরে জীবন শুরু হয় শিশুর ; পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে মানুষ হবার বয়সে। প্রিয় অর্ণ সবে মানুষ হবার বয়স হয়েছিলো মাত্র অথচ পরিপূর্ণ মানুষ হবার পূর্বেই তাকে পৃথিবীর স্থান ছেড়ে দিতে হলো, ছেড়ে যেতে হলো বাবা-মা,ভাই-বোন, সহপাঠী বন্ধু স্বজন। আমরা জন্ম-মৃত্যুর বিধান জানি,জানি না মৃত্যর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে ধর্ম,দর্শন ও বিজ্ঞানে ভিন্ন মতবাদ বা মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আমরা স্রষ্টা প্রদত্ত সংবিধানে অনুগত হই পূর্ণ বিশ্বাসে। বিশ্বাস হলো দৃশ্যমান বস্তুর সাথে লিখিত বা পঠিত বিষয়ের সাদৃশ্য বা মিল। পক্ষান্তরে এক অদৃশ্য শক্তির প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রকাশের নামই হলো বিশ্বাস । শেষ কথা বিশ্বাসই হলো স্রষ্টা,আল্লাহ,ঈশ্বর,ভগবান আমরা যে নামেই ডাকি না কেন তিনিই একমাত্র শক্তি যিনি পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস তিনিই পরমসত্তা।
সৃষ্টির পর থেকে আজ অব্দি মানুষ জন্ম নিয়েছে, জন্ম নিচ্ছে,জন্ম নিবে এবং মৃত্যু হয়েছে,মৃত্যু হচ্ছে,মৃত্যু হবে এবং একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে গোটা পৃথিবী। এটাই জন্ম-মৃত্যুর সরল প্রক্রিয়া এই জন্ম নেয়াটা মানুষের ইচ্ছাধীন নয়, জন্ম দেয়াটা মানুষের ইচ্ছাধীন।সৃষ্টিতে স্রষ্টা একক শক্তি তিনিই পরমসত্তা, তার কোন সহযোগী নেই অথচ জন্মে দ্বৈত ভূমিকা থাকে পিতা-মাতার। এই মানুষের ভেতরেই আবার স্রষ্টা অবস্থান করেন। এই যে জন্মের সাথে মৃত্যুর বন্ধন এটাও বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। আল্লাহর উপর  বিশ্বাস আছে বলেই আমরা জন্ম-মৃত্যুকে মনে নিই, মেনে নিই। এই মনে নেয়া আর মেনে নেয়াটা জন্মের ক্ষেত্রে আনন্দের হলেও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অধিক কষ্টের।
বাবা-মায়ের আগে সন্তানের মৃত্যু হলে সেই আঘাত মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়ে অধিক কষ্টের। তবুও আমরা বিশ্বাস করি মানুষের অন্তরেই স্রষ্টার আবাস।
অর্ণের মতো হাজারো শিশু কিশোর জন্ম-মৃত্যুর এই অসম আসা যাওয়া যেন ষ্টেশনে পরে আসা ট্রেনের মতো ! অর্ণ বাপ আমার, তুমি তো পরে এসেছিলে পৃথিবীতে,অনেক পরে তবে কেন তুমি আগেই চলে গেলে না ফেরার দেশে? যে দেশ থেকে আর কখনো কেউ ফিরে আসে না।
আমরা জানি পৃথিবীতে মানুষের আগমন এবং উর্ধলোকে প্রস্থান কোনটাই রেল লাইন ধরে চলে না। আমাদের অবুঝ মন মৃত্যু নামক সত্যটাকে মেনে নিতে পারে না বলেই অতি আবেগে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে কী অপরাধ ছিলো অর্ণের,যে তাকে এই অসময়ে সময় হলো চলে যাবার?  এমন প্রশ্ন হাজার মানুষের। তবে এটা মানুষের সহজাত কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। আমরা জানি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সমান ওজন হয়ে যায়। এ ভার বহন করার ক্ষমতা কোন বাবাই রাখেন না। তবুও বহন করেন এবং সে সক্ষমতার যোগান তিনিই দিয়ে থাকেন।
দূরন্ত শৈশবে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতো যে ছেলেটি, দেখে মনে হতো বাবা যেন একটা কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ,ছেলে ফুল হয়ে ফুটে আছে শাখা প্রশাখায়।  মায়ের পাশে বসে যখন স্কুলে যেতো, মনে হতো মা যেন মাথার উপর নীলাকাশ আর ছেলেটি সেই আকাশ ছুঁয়ে থাকা প্রদীপ্ত রবি। আজ সকাল থেকে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষটি শোকে মুহ্যমান,কলি থেকে ফুল ফুটছে না আর, ফুটবে না আর কখনোই। কেন আজ হঠাৎ দুপুরের আগেই অস্তমিত হলো সকালের সূর্যটা। এ আমার অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নয়,এ আমার আক্ষেপ নয়, এ আমার অজ্ঞতা প্রসূত দুঃখবোধ। মানুষের একটাই জীবন অথচ ইচ্ছে বহুতর। মানুষ হবার দূর্বার ইচ্ছা নিয়ে ছেলেটির এগিয়ে যাওয়া আমাদের মননে ঋদ্ধতার চিত্রকল্প এঁকে দিয়েছিলো।পড়া লেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সে বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলো। স্টেডিয়াম কিংবা জিলা স্কুলের সবুজ ঘাসের অন্তর জুড়ে ছিলো তার সরব পদচারনা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলো অর্ণ। নৈতিক ও মানবিক গুণাবলিতেও সে অন্যসব বন্ধুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো।
শ্রেষ্ঠ মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষক, পাশাপাশি বাবা -মা-ই সন্তানের প্রথম শিক্ষক এবং একই দায়িত্ব নিয়ে সন্তানকে আদর্শ ও মানবিক মানুষ করে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। বাবা-মা তাদের কারিগর হাতে কাঁদামাটির তৈরি সন্তানকে সোনার মানুষে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। মনের আলমিরায় হাজারো ইচ্ছের ফুল সাজিয়ে সুগন্ধি ছড়াতে চেয়েছিলেন। আজ অর্ণ নেই, মাটির মানুষ মাটিতেই মিলেয়ে গেছে। সক্রেটিস হেমলক পান করার পর বলেছিলেন তোমরা দুঃখ করো না মনে রেখো মৃত্যু কেবল আমার দেহটাকেই  বিনাশ করবে আত্মাকে নয়। অর্ণ আজ তুমি নেই অথচ তোমার অবিনাশী আত্মা আমাদের অন্তরে ভালোবাসায় চির জাগরুক থাকবে চিরদিন। মনে এখন বেদনার বহ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে তবুও তুমি আমাদের অন্তরাত্মা হয়ে চির অম্লান রবে। অর্ণ ছিলো বাবা-মায়ের অন্তরে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ অথচ আজ তা অন্তরেই শুকিয়ে গেছে।
বন্ধু হারানোর বেদনায় নির্বাক বন্ধুরা,শোকে বিহ্বল প্রাণহীন দেহের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে। মাঝে মাঝে  কবরস্থানে বন্ধু অর্ণের জন্য নিরবে প্রার্থনা করে। খেলার মাঠে অর্ণের পদচিহ্ন খুঁজে ফেরে রোজ। পুকুর ঘাটে সেই বসার জায়গাটি সযত্নে আগলে রেখেছে এখনো। ভুলে থাকার চেষ্টায় ভুলে যেতে চায় অর্ণের সব স্মৃতি কিন্তু পারে না,পারা যায় না। যে জল প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে মানুষের সেই জলই সংগোপনে প্রাণ কেড়ে নেয় মানুষের। অর্ণ অসম্ভব সম্ভাবনাময় একটা জীবনের নাম অথচ খেলার ছলেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো সেই জীবনের। আহা কী নির্মম কী নিষ্ঠুর এই মৃত্যু। অর্ণ বাঁচতে চেয়েছিলো কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করে সাধ্য কার?
আজ বাকরুদ্ধ পরিবার পরিজন, বন্ধু, সুহৃদ স্বজন । বাবা- মা তাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু না তিনি যাকে নিতে  চান তাকে আর ফেরত দেন না কখনোই।এই পরম ও চরম সত্যটাকে মেনে নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস যোগাতে হবে মনে। যিনি সৃষ্টি করেছেন জীব জগৎ কিংবা বিশ্বব্রম্মাণ্ড মৃত্যু এবং ধবংস করার ক্ষমতা তিনিই সংরক্ষন করেন।
পরিসংখ্যান বলে প্রতিবছর বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে তন্মধ্যে সাঁতার না জানার কারণেই অধিকাংশ শিশু কিশোরের মৃত্যু হয়। শিশুরা মারা যায় অভিভাবকদের অসতর্কতার কারণে।
ছেলে মেয়েদের জন্য সাঁতার শেখা কতটা জরুরী তা উপলদ্ধি করেই অর্ণ মারা যাবার পরের দিন রাজবাড়ীতে অর্ণের স্মৃতি রক্ষার্থে “অর্ণ সুইমিং ক্লাব” নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য রাজবাড়ী জেলার বিশেষ করে শহরে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানো। এই মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কিছু ব্যক্তি এগিয়ে এলেও প্রয়োজন সরকারি/বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতা।  এই সংগঠনের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে প্রতিটি ছেলে মেয়েকে সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম শুরু হলে অবশ্যই সফলতা আসবে এবং মা-বাবার বুক শূন্য করে হাজারো শিশু, কিশোর-কিশোরীকে আর পানিতে ডুবে  অকালে প্রাণ হারাতে হবে না। আমরা আর হারাতে চাই না মেধা,তন্ময়,রহমান ও অর্ণের মতো আরো অনেক নাম না জানা মেধাবী এবং সম্ভাবনাময় জীবন। অর্ণ তুমি আমাদের অন্তরাকাশে উজ্জল নক্ষত্র হয়েই থাকবে চিরদিন। জান্নাতের সব দরজা খোলা রবে তোমার জন্য।