রাজবাড়ীর অবহেলিত স্কুল-কলেজের প্রাচীরগুলো তরুণদের রঙে-তুলির ছোয়াতে ফুটে উঠলো জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদদের স্মৃতি।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে “জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠান মালা ২০২৫”-এর অংশ হিসেবে রাজবাড়ীতে আয়োজিত হয় জেলা পর্যায়ের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র প্রতিযোগিতা।
রাজবাড়ী জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ গ্রাফিতি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় জেলার পাঁচটি উপজেলার বাছাইকৃত স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ২৪টি দল অংশগ্রহণ করে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের অংশ হিসেবে রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, টাউন মক্তব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের দেয়ালে অঙ্কিত হয় শহীদ মীর মুদ্ধ ও শহীদ আবু সাঈদের প্রতিকৃতি। প্রাচীন দেয়ালগুলো যেন হয়ে ওঠে জীবন্ত ইতিহাসের ক্যানভাসে, যেখানে রঙের প্রতিটি রেখা বলে দেয় একটি জাতির প্রতিবাদের গৌরবগাথা। এই দেয়ালচিত্র এখন শুধু একটি ছবি নয়, বরং মানুষের মনে স্মৃতির দ্বার খুলে দিচ্ছে। অনেক পথচারীই থেমে পড়ছেন, তাকিয়ে থাকছেন, কিছুক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন।
ডা: আবুল হোসেন কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম বলেন, “জুলাই ২০২৪ এই সময়টা আমি কখনো ভুলতে পারব না। প্রতিবাদ মানে শুধু স্লোগান নয়, ত্যাগও আছে। আজ দেয়ালে যখন তাদের ছবি আঁকি, মনে হয় তারা এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, সাহস দিচ্ছেন। এই স্মৃতি, এই শক্তি—আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।”
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ ও সরকারি গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের ছাত্রী জেরিন আক্তার সহ একাধিক শিক্ষার্থীরা বলেন, “আমরা যখন জুলাই বিপ্লবের ছবি আঁকছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন ইতিহাসের এক অংশ হয়ে যাচ্ছি। শহীদদের মুখ আঁকতে আঁকতে হৃদয়ে ভেসে উঠছিল তাঁদের সাহস আর আত্মত্যাগের গল্প।” এই দেয়ালচিত্র আমাদের কাছে কেবল একটা শিল্প নয়, এটা আমাদের দায়িত্ববোধের প্রকাশ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে করিয়ে দেবে, সত্যের জন্য কেমন করে দাঁড়াতে হয়।”
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ বলেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা শুধু ছবি আঁকেনি, তারা যেন ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখেছে, অনুভব করেছে এবং নতুন করে প্রাণ দিয়েছে। “এই দেয়ালচিত্র একবার আঁকা হলেও, শিক্ষার্থীদের মনে যে ছাপ ফেলেছে তা দীর্ঘস্থায়ী। এখন তারা শুধু বইয়ের ইতিহাস নয়, জীবনের ইতিহাস জানছে। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের দায়িত্ববোধ তৈরি হচ্ছে।”
রাজবাড়ীর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. হাবিবুর রহমান জানান, “এই আয়োজন শুধু জেলা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। জেলা পর্যায়ের বিজয়ীরা আগামী ২৩ জুলাই বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। এতে তারা নিজেদের জেলা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে।”
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, “জুলাই পুনর্জাগরণ শুধু স্মরণ নয়, এটি একটি আন্দোলন যা সময়ের সঙ্গে আরও বিস্তৃত হবে। আমরা চাই ইতিহাস যেন শুধু অতীত না থেকে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের শক্তিতে পরিণত হয়। এই দেয়ালচিত্র ও শিল্পকর্ম সেই চেতনাকে শক্তিশালী করবে।”
রাজবাড়ীর দেয়াল এখন আর নীরব নয়। সেখানে আঁকা শহীদদের মুখ যেন জেগে আছে আমাদের চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে। এসব দেয়ালচিত্র শুধু শিল্প নয়, এক জীবন্ত ইতিহাস, এক চলমান পাঠশালা, এক আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞান।